পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও অন্যান্য লেখক নকশী কাঁথা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সবাই একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন, নকশী কাঁথার প্রতিটি সুচের ফোঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে একেকটি পরিবারের কাহিনী, তাদের পরিবেশ ও জীবনগাঁথা। কেউ কেউ লিখেছেন, এই কাঁথার প্রতিটি ফোঁড়ে থাকে পরিবারের নতুন সদস্যদের প্রতি শুভকামনা, স্নেহ ও ভালোবাসার পরশ। নকশী কাঁথার স্মৃতি ও স্বপ্ন কাহিনীর মতোই, সদ্য বিবাহিত যেকোনো দম্পতির প্রতিটি সেকেন্ডই একেকটি স্বপ্নের সিঁড়ি। তারা একে অপরের চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যায় আগামীর পথ চলায়। স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে প্রতিটি মুহূর্তে। তারা ভ্রমণ করতে পছন্দ করে, একে অপররে মনের কথাগুলো একান্তে বলতে চায়, শুনতে চায়। সেদিনও একটি নব দম্পতি একে অপরের হাতে হাত রেখে সিলেটে এমসি কলেজের কাছে আনন্দ ভ্রমণে যায়। আফসুস! সেই যাত্রাপথে তাদের স্বপ্নকে শেষ করে দেয় কিছু পাষণ্ড। এক নিমেষেই কলঙ্কের কালি মেখে দেয় নতুন শাড়ীর আঁচলে। স্বামী হয়তো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যাশা করেছিলেন তার ভালোবাসার মানুষটির কোনও ক্ষতি হবেনা। কিন্তু সেখানে কোন বিবেকবান চরিত্র নেই। তাকে বেঁধে রেখেই তার প্রাণের প্রিয় মানুষটিকে গণধর্ষণ করলো এমসি কলেজের ৬/৭ জন পাষণ্ড। আহ! কী লোমহর্ষক। ৬/৭ টি ছেলের মধ্যে একটি ছেলেও কি বিবেকবান হতে পারতো না? তাহলেও হয়তো মেয়েটাকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো যেত। ঐ কাপুরুষদের জন্য দম্পতির নতুন জীবনের স্বপ্নছোঁয়ার যাত্রায় নেমে এলো কালো ছায়া।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশি নারীদের সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছিল রাজাকারদের নিয়ে। তখনকার সময়ে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচলেও রাজাকারদের কারণে বাঁচতে পারতো না। ঠিক যেন আমরা একাত্তরে ফিরে গেছি। স্বামী-স্ত্রী একসাথে রাস্তায় চলাচল করলেও নিরাপদ নয়। এরাতো রাজাকারদেরও হার মানিয়েছে। তখন নাহয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি পায়নি, কিন্তু বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে এসব হচ্ছেটা কী! করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশে গত ৩ মাসে একের পর এক ধর্ষণের খবরে উদ্বিগ্ন প্রতিটি পরিবার। ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ নিরাপদ থাকতে পারছে না। লাগাম টেনে ধরার কেউ নাই! সমাজের অবক্ষয় দিন দিন এভাবে বাড়তেই থাকবে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচারের গতি বাড়ানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। যতই চাপ থাকুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের এমসি কলেজসহ সকল ধর্ষণের অভিযোগগুলোর দ্রুত তদন্ত করে বিচার করা উচিত।
ইদানীং ধর্ষণসহ আরও কিছু অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন ছাত্রলীগের বেশ কিছু সদস্যদের বিরুদ্ধে। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বারবার, অস্বস্তিতে পরতে হচ্ছে সিনিয়র নেতাদের। আমার মতে, ছাত্রলীগের সকল কমিটি আপাতত স্থগিত রাখা উচিত। তারপর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে একেকজন করে শপথ পাঠ করিয়ে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এধরণের অন্যায় করলে দায়ভার তার দল নিতে পারে। বর্তমান সময়ে ছাত্রলীগ কি তার কোন কমিটি বা ইউনিটকে অপরাধমুক্ত ঘোষণা করতে পারবে? যদিও ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য দাবী করেছেন, নারীর প্রতি খারাপ চোখে তাকানোর মতো কর্মী ছাত্রলীগে নেই। আমারতো মনে হচ্ছে, প্রত্যেকটি কমিটিতেই বিতর্কিত বা অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত কর্মী রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নিজের আদর্শে গড়া সংগঠন এভাবে বিতর্কিতভাবে পরিচালিত হবে, এটা খুবই দুঃখজনক। যাদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশের উন্নয়ন কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা, তারাই যদি অপরাধে লিপ্ত থাকে, সেখানে সীমাহীন দুঃখপ্রকাশ ছাড়া আর কী বলার থাকে! আমি এখনো বিশ্বাস রাখতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ছাত্রলীগ তার আদর্শিক ঐতিহ্য আবার ফিরে পাবে।
পরিশেষে, সকলের ঐ দম্পতির পাশে থাকা উচিত। তারা যাতে সব আঘাত ভুলে নতুনকরে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারে সেই সাহস দেয়া উচিত। এটি একটি দুর্ঘটনা, যেখানে তাদের কোন হাত ছিলনা। আঘাত থেকে শক্তি সঞ্চয় করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মনোবল দৃঢ় রেখে এগিয়ে চলা উচিত। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, এই নব দম্পতির বন্ধন যেন আরও সুদৃঢ় হয়।